২৪ দিন হাসপাতালের বারান্দায় পড়ে ছিলেন লীলা, অবশেষে মিলল মানবিক সেবা
মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের বারান্দায় ২৪ দিন ধরে পড়ে থাকা অজ্ঞাতপরিচয় এক নারীকে অবশেষে মানবিক সেবায় ভর্তি করা হয়েছে হাসপাতালে। লীলা বাউড়ী নামের এই নারী কখনো একজন মা ছিলেন—সন্তান জন্ম দিয়েছিলেন, নিজের রক্তে বড় করেছিলেন তাকে। অথচ সেই মা-ই ধুলোময়লা, পোকামাকড় ও অবহেলার মধ্যে পড়ে ছিলেন হাসপাতালের এক কোণে।
গত ১১ জুন রাতে কে বা কারা তাকে হাসপাতালে ফেলে রেখে যায়। এরপর টানা ২৪ দিন রোদ-বৃষ্টি উপেক্ষা করে, অমানবিক কষ্ট সহ্য করে লীলা জীবনযুদ্ধে লড়ে গেছেন বারান্দার এক কোণে। হাঁটতে বা দাঁড়াতে না পারায় যেখানে শুয়ে ছিলেন সেখানেই মল-মূত্র ত্যাগ করতে বাধ্য হতেন। খাবারের জন্য হাসপাতালের আগত রোগীদের অভিভাবকদের দিকে তাকিয়ে থাকতেন। কেউ হয়তো এক টুকরো পাউরুটি, কলা বা এক কাপ চা দিয়ে যেতেন। তবুও তার চোখে-মুখে ছিল বাঁচার আকুতি।
এই নারীর করুন অবস্থা নজরে পড়ে স্থানীয় সামাজিক সংগঠন "হৃদয়ে কমলগঞ্জ"-এর সিনিয়র স্বেচ্ছাসেবক মো. সাইদুল ইসলাম ও সাংবাদিক আব্দুল মালিক-এর। এরপর শুরু হয় এক মানবিক সংগ্রাম—পরিচয়হীন এই মাকে বাঁচানোর লড়াই। সামাজিক মাধ্যমে ছবি পোস্ট করে পরিচয় জানার চেষ্টা চালান তারা। ময়মনসিংহে খোঁজ করেও খুঁজে পাওয়া যায়নি তার সন্তান রঞ্জিত বাউড়ী বা অন্য কোনো স্বজন।
সমাজকর্মী ও শিক্ষক মো. জুলফিকার আলী সোয়েব-এর পাশাপাশি আরও অনেকে পাশে এসে দাঁড়ান। প্রতিদিন খাবার, রাতে কয়েল, বৃষ্টির দিনে পাশে বসে থেকে ছায়ার মতো ছিলেন সাইদুল ইসলাম। সেই বারান্দায়, যেখানে কেউ দাঁড়াতে চায় না, সেখানে একজন সন্তান হয়ে মায়ের পাশে থেকেছেন।
গোপালনগর জামে মসজিদের মুয়াজ্জিন মাওলানা শাহিন আহমেদ শিপন নিজ হাতে গোসল করিয়ে পরিষ্কার করেছেন লীলাকে ও তার আশপাশের জায়গা। এরই মধ্যে ৪ জুলাই বিকেলে ইবনে সিনা হাসপাতালের শিশু ও নাক-কান-গলা বিশেষজ্ঞ ডা. এস. কে. নাহিদ এসে প্রাথমিক চিকিৎসার নির্দেশ দেন এবং দ্রুত ভর্তি করার আহ্বান জানান।
পরদিন শনিবার (৫ জুলাই) সকাল ১০টায় হৃদয়ে কমলগঞ্জ-এর প্রতিষ্ঠাকালীন সদস্য ইয়াকুব আলী হোয়াটসঅ্যাপে একটি মানবিক গ্রুপ তৈরি করেন। সেই গ্রুপে সকলে মিলে লীলাকে গোসল করিয়ে নতুন কাপড় পরিয়ে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করানো হয়।
এই মহান উদ্যোগে সহায়তা করেন—নিসচা কমলগঞ্জ শাখার সভাপতি আব্দুস সালাম, হৃদয়ে কমলগঞ্জের সদস্য সোলায়মান উদ্দিন, সোহান আহমেদ, বাবলু আহমেদ, জাবেদ আহমেদ, আল আমিন, কামাল আহমেদ, জয়ন্ত দেব ও সিপার উদ্দিন।
স্বেচ্ছাসেবক মো. সাইদুল ইসলাম বলেন, “মানবতা আমাদের শিখিয়েছে দায়িত্ব নিতে। আজ এই মা যেন আবার সম্মান নিয়ে বাঁচতে পারেন—সেটাই আমাদের একমাত্র চাওয়া। তবে এখন আরেকটি চ্যালেঞ্জ, তাঁর চিকিৎসা এবং সার্বক্ষণিক নারীকর্মীর ব্যবস্থা করা। আমরা একা পারছি না, সবাইকে পাশে চাই।”
কমলগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. মাহবুবুল আলম ভূঁইয়া জানান,
> “আমি ব্যক্তিগতভাবে তাঁর খোঁজ রাখছি। হাসপাতালের সব স্টাফদের বলেছি যেন প্রয়োজনে আমাকে জানায়।”
কমলগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মাখন চন্দ্র সূত্রধর বলেন,
> “আমরা তার পরিবারের খোঁজে কাজ করছি। পাশাপাশি সমাজসেবা অধিদপ্তরকে জানিয়েছি, যেন প্রয়োজনীয় সহায়তা নিশ্চিত করা হয়।”